নবীজি সাঃ গরুর গোসত খাননি
সৌদি প্রবাসী একজন সালাফী আলেম বলেছিলেন, নবীজী সা. গরুর গোশত খাননি। সেই আলেমের বক্তব্য নিয়ে যখন চারদিকে সমালোচনা তখন তার চিন্তাধারায় একাত্মতা রাখেন এমন লোকদের দ্বারা পরিচালিত ৬ লক্ষাধিক লাইকের একটি পেইজ Universal Vision থেকে গরুর গোশত অসুখের কারণ বলে হাদীস প্রচার করা শুরু করে দিল। সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি বলে কিছু একটা থাকা দরকার ছিল উনাদের!
এই হাদীস আমি নিজেও আগে কখনো শুনিনি। তাই এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। আলবানী রাহ. এর সিলসিলাহ সহীহাহ সহ আরো কিছু কিতাব থেকে এর তাহকিক দেখলাম।
প্রথম কথা হলো, এই বিষয়ে যতগুলো হাদীস এসেছে সেগুলোর কোনটারই সনদ আপত্তিমুক্ত নয়। সবগুলোতে নানান ধরনের 'নাকারাত' আছে। আলবানী রাহ. এর তাহকীক মতে যদিও সনদের সেসব ত্রুটি হাদীসটিকে সহীহ বা হাসান করতে অসুবিধা সৃষ্টি করছে না। এর দ্বারা বুঝা গেল, হাদীসটার বিশুদ্ধতা সর্বসম্মত নয়। সিলসিলা সহীহাতে থাকলেই সহীহ বলে মানা অত্যাবশ্যক হয়না। যারা তাকলীদের বিরোধিতায় জীবন পার করে, দুঃখজনকভাবে তারাই আবার সিলসিলা আহাদীসকে তাসহীহের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলার মত মানসিকতা প্রদর্শন করে। এটাও যে তাকলীদ বুঝতে পারে না।
যাইহোক, প্রথম কথা হলো হাদীসটা শুদ্ধ না। এর সনদে বিভিন্ন ত্রুটি আছে।
ক. সাইফ বিন মিসকীন নামক রাবি বিভিন্ন জাল বিষয় বর্ণনা করত। তিনি গ্রহণযোগ্য নন। (আল-মাজরূহীন, ইবনু হিব্বান: ১/৩৪৭)
খ. এই কারণে ইমাম হাকীম এর সনদকে সহীহ বলার উপর যাহাবী রাহ. আপত্তি করেছেন তার তালখীসে।
গ. মাসউদী নামক রাবির ইখতিলাতের সমস্যা ছিল।
ঘ. হাদীসের সাহাবী ইবনে মাসউদের সাথে তার ছেলে আবদুর রহমানের ইনকিতা বা বিচ্ছিন্নতা এর সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ তিনি বয়সে ছোট হবার কারণে পিতার থেকে সরাসরি হাদীস শুনেছেন কিনা সেই বিষয়ে বিতর্ক আছে।
ঙ. আল্লাম যারকাশী রাহ. বলেছেন, এটি সহীহ হবার বিষয়ে আপত্তি আছে। কেননা নবীজি সা. নিজে তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু কুরবানী করেছেন। আর তিনি কোন অসুখওয়াল জিনিস দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার মত নন। (আত-তাযকিরাহ: ১৪৮)
চ. সাখাবী রাহ. বলেছেন, এটি যঈফ। (আল-আজওয়িবাহ : ১/২৩)
ছ. ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন, এটি বিভিন্ন যঈফ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
(অন্য রেওয়ায়েতকে আলবানী রাহ. হাকিমের এই সনদকে শাহেদ ধরে তার ভিত্তিতে হাসান বলতে চেয়েছেন। ভিত্তিটার অবস্থাই নড়বড়ে, দেখতেই পাচ্ছেন।)
যদি আমরা আলবানী রাহ. এর তাহকীক মেনেও নেই তবুও দেখেন তিনি নিজে এর কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রথমত তিনি সিলসিলা সহীহাতে সাখাবির আল-মাকাসিদের বরাতে ব্যাখ্যা এনেছেনন- এটা হিজায অঞ্চলের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বলা হয়েছে। যেন এটি এই অঞ্চলের সাথেই সম্পৃক্ত বিধান। (যেসব অঞ্চলে এমন সমস্যা নেই, সেখানে তা ক্ষতিকর বিবেচিত হবে না।) (আল-মাকাসিদুল হাসানাহ, সাখাবী; ৪৬৪; সিলসিলা সহীহা : ৪/৪৭)
আলবানী রাহ. তার প্রশ্নোত্তর সংকলন 'সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নুর' এ বলেছেন, 'গরুর গোশত খেতে পারেন। এতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা নবিজি ও তার পরিবারের লোকেরা গরুর গোশত খেয়েছেন। বিদায় হজে নবীজি তার পরিবারের পক্ষ থেকে গরু কুরবানিও করেছেন। তবে আমার নসীহত হলো, খুব বেশি পরিমাণে খাবেন না। হাদীসে মূলত এটাই বুঝানো হয়েছে।' ('সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নুর', নং- ২৩৬)
যেই আলবানী রাহি. এর সিলসিলা সহীহার তাহকীক দিয়ে হাদীসটা তারা প্রচার করছে, তিনি নিজেও তো তাদের এই প্রচারণার সাথে একমত হতেন না বলেই প্রতীয়মান হয়।
এখন আপনারাই বিচার করেন, এমন একটা মুহুর্তে এই ধরনের একটা হাদীসকে প্রচার করার কী মানে হতে পারে? তাদের দেওয়া পোস্ট থেকে শুধু হাদীসটা পড়ে কী বুঝলেন আর এই প্রসঙ্গে আমার লেখা থেকে বিস্তারিত জেনে কী বুঝলেন? দুইটাকে মিলান। দেখবেন দুই বুঝের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
দুদিন পরে দেখবেন, যারা এদেশে গরু কুরবানি না করার কথা বলে, তারা উনাদের প্রচারণা থেকে হাদীসটা জেনে খোদ আমাদের বিপক্ষেই এর ব্যবহার করা শুরু করবে। আল্লাহ সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
©Shaik Abdullah Al Masud hafizahullah
No comments